শুকনো ফুল

  • Post author:

২০১১ এর কোন এক শীতের দুপুর।
জগন্নাথ ভার্সিটির ভর্তি পরীক্ষা দিতে বের হয়েছি। আমার কোথাও চান্স হবে- মনে এমন আশার ছিটেফোঁটা ও নেই। তবু ফর্ম কেনা ছিলো তাই পরীক্ষা দিতে আসা। রাস্তায় হাজার হাজার গাড়ি জ্যামে আটকে আছে। দেরি হয়ে যাবে মনে করে রিকশা থেকে নেমে হাটতে লাগলাম। পুরনো ঢাকার ঘিঞ্চি গলি দিয়ে হাটছি, ভালোই লাগছে। হঠাৎ একমেয়ে কন্ঠ পেছন থেকে ভেসে আসলো – ‘জগন্নাথ ভার্সিটির রাস্তা কি এটাই?’

  • হ্যা, সামনের গলি পেরোলেই মেইন রোড।
    -অহ।
    হাতে এডমিট কার্ড দেখে বুঝলাম মেয়েটা ও আমার মতো পরীক্ষা দিতে আসছে। আমি হাটতে লাগলাম।

আমার সিট পরেছে ছোটখাটো হস্তিনীর পাশে। এই হস্তিনী একটু পর পর ই ফিসফিস করে এমসিকিউ এর উত্তর জানতে চাইছে, আমি পুরো খাতা হস্তিনীর কাছে জমা দিয়ে টয়লেটের নাম করে বের হলাম। ভাবলাম বাসায় চলে যাই, বের হওয়ার পরে কেন জানি মনে হলো সেই মেয়েটা ও তো পরীক্ষা দিচ্ছে, এখন গেলে তো আর দেখা হবে না। ভেবে আবার দৌড়ে গেলাম ক্লাসে। হস্তিনী এতোক্ষণে আমার ভুলভাল উত্তর সব কপি করে বসে আছে।

পরীক্ষা শেষে সব ছেলেমেয়ে একসাথে হুমড়ি খেয়ে বের হচ্ছে। গেটের কাছে চরম ভীর। আমি খুজছি সেই মেয়েটিকে। খুজলে নাকি ভগবান কেও পাওয়া যায় এই ভরসায় উঁকিঝুঁকি মারছি। হঠাৎ দেখি মেয়েটা খুব ই ভীত কিংবা আতংকে জড়সড় হয়ে এক কোণায় দাড়িয়ে আছে। ভীর ঠেলে বের হতে পারছে না। আমার এতো মায়া লাগলো যে সামনে গিয়ে দাড়ালাম, চরম সাহস দেখিয়ে দুইহাত দিয়ে দেয়াল বানিয়ে মেয়েটাকে গেট থেকে বের করলাম। ঠেলাঠেলি ধাক্কা সব আমার উপর দিয়ে যাক, নিরাপদ থাকুক মেয়েটি।

ততক্ষণে বাইরে সন্ধ্যা নেমে গেছে। এই ভীরের সময় রিকশা গাড়ি কিছুই পাওয়া যাবে না ভেবে হাটা শুরু করলাম। মেয়েটি ও পাশে পাশে আসছে। বললাম

  • কোথায় যাবেন?
    -ফার্মগেট। এখান থেকে কি রিকশা যাবে?
  • এতোদুর তো যাবে না বোধহয় , আর গেলেও এখন রিকশা পাবেন না। হেটে নয়াবাজার পর্যন্ত গেলে পাওয়া যেতে পারে।
    -আমি এইদিকে কিছুই চিনি না, আমাকে একটু এগিয়ে দেবেন?

সেই মূহুর্তে আমার মনে কি যে এক আনন্দ খেলে গেলো তা বলে বুঝাতে পারবো না। মনে মনে বললাম আপনি চাইলে আমি সারা ঢাকা শহর এগিয়ে দেবো।

বহুকষ্টে এক রিকশা ঠিক করলাম, রিকশা শাহবাগ পর্যন্ত যাবে। চাইলে আমি তখন ই চলে যেতে পারতাম, কিন্তু সন্ধ্যাবেলা মেয়েটিকে একা ছাড়তে মন সায় দিলো না। কেমন একটা দ্বায়িত্ববোধ এসে চাপলো। দুজন পাশাপাশি বসলাম, সেটাই ছিলো আমার জীবনে প্রথম কোন মেয়ের পাশে রিকশায় বসা। হঠাত মেয়েটা কথা বলা শুরু করলো,
-আপনার বাসা কোথায়? আপনার দেরি হয়ে যাচ্ছে না?

  • আমার দেরি নিয়ে সমস্যা নেই, আপনি একা কিভাবে যাবেন, চলুন এগিয়ে দেই।
  • শাহবাগ থেকে আমি চিনবো। পরীক্ষা দেওয়ার জন্য ঢাকা এসেছি, তেমন কিছু চিনি না তো তাই…
  • সমস্যা নেই, ভর্তি হয়ে গেলে তখন সব চিনে যাবেন।
  • যদি চান্স ই না পেলাম?
  • পাবেন, ভরসা রাখুন।
    শাহবাগ চলে এসেছি, মেয়েটিকে আরেকটা রিকশা ঠিক করে দিলাম। মেয়েটি বললো একাই যেতে পারবে। রিকশায় উঠতে মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করলাম – আপনার নাম?
    মেয়েটি চমৎকার একটা হাসি দিয়ে বললো
    “দোলনা রায়”

রিকশা টা ভীরে হারিয়ে গেলো, মাথায় শুধু সেই নামটি ই সাইরেনের মতো বাজতে লাগলো। ফোন নাম্বার, কোন ঠিকানা কিছুই জানি না। ফেসবুকে সার্চ করে এই নামের অসংখ্য আইডির মধ্য থেকে তাকে আর খুজে পেলাম না।

সময়কাল ২০১৯ সালের অক্টোবর মাস। এক ব্লাড ডোনেশন গ্রুপ থেকে আমাকে ফোন করা হলো-
এক গর্ভবতী নারীর জন্য ইমার্জেন্সি রক্তের প্রয়োজন, রক্তের গ্রুপ ও পজিটিভ। ভদ্রলোকের নাম্বারে
যোগাযোগ করে হাসপাতাল গেলাম। রক্ত দিয়ে চলে আসবো এমন সময় ভদ্রলোক বললো
-ভাই কিছু মনে না করলে আমার স্ত্রীর সাথে একটু দেখা করে যান, ও অনেক ভয়ে আছে, আর ঢাকায় আমাদের তেমন কেউ নেই, আপনাকে কি বলে ধন্যবাদ দেবো আমার জানা নেই।
গেলাম পাশের কেবিনে। ভুত দেখার মতো চমকে দেখি এ যে সেই মেয়েটা, যার নাম দোলনা রায়! একটু মোটা হয়েছে, চেহারায় এখনো সেই মায়া জড়ানো। ঘুমিয়ে আছে, তাকে লাগছে গ্রীকদেবীর মত। আমি ভদ্রলোককে নিষেধ করলাম ডেকে তুলতে। আমি চলে এলাম, আর ভাবতে লাগলাম পৃথিবী আসলেই খুব অদ্ভুত। রক্ত দিতে পারা এমিনিতেই আনন্দের, আর সেটা যদি হয় ০৯ বছর আগে হারিয়ে যাওয়া দোলনা রায়ের জন্য- তা ব্যাক্ষা করা কঠিন। ভীষণ কঠিন।


10 April, 2020
Home Quarantine Days…

লেখক: হানিফ মোহাম্মদ

https://www.facebook.com/jojo.haneef

This Post Has One Comment

  1. Haneef Mohammad

    বাহ, ছেলেটা তো সুন্দর লিখেছে, বড় হলে আরো চমৎকার লিখবে সজীবভাইয়ের মতো। 🙂

Leave a Reply