রঙ মিলান্তি পর্বঃ ০২ (শফিকের প্রয়াণ)

  • Post author:

শফিকের শণিবার আলো নিয়ে ভোর হয়নি। শ্যামলা শরীরে গাঢ় নীল বিষে নিলাকার হয়েছিলো। শফিক জানতো এভাবেই তাকে থেমে যেতে হবে।
বাইশ বছরে অনার্স শেষ করে চাকুরীর জন্য কম ঘুরেনি। গোটা ত্রিশেক ইন্টার্ভিউ, দু জায়গায় খন্ডকালীন চাকুরী, ছোট মামার মাধ্যমে মালেয়শিয়া যাওয়ার জন্য তিন লাখ জমা দিয়ে দালালের খপ্পরে পড়া, বন্ধুর সাথে গার্মেন্টস লট ব্যবসায় ধরা খাওয়া, কি নেই শফিকের গত দু বছরের জীবনে!
এডভেঞ্চার? নাহ, এটাকে এডভেঞ্চার বলা যায় না। যে বয়সে মানুষ কর্মজীবনে প্রবেশের পুরো শক্তি দিয়ে নামতে চায়, এদেশে সে বয়সে বাংলা সিনেমার সাদা কালো, জুতোর তলা খোসা, চাকুরী খোজা মিশন।
হাপিয়ে পড়ে শফিক। বাবার থেকে টাকা চাওয়ার মুখ নেই। এদিকে আবার রেখার বাসায় বিয়ের চাপ। এখন আর রেখা আগের মত রাত জেগে স্বপ্নের কথা শুনায় না, গান শুনায় না শুক্রবারের বেড়াতে যাওয়ার বায়না করে না। সে শুধু শফিককে বিয়ের জন্য অনুরোধ করে। শফিকের ভালো লাগে না। নিজেরই যেখানে অবস্থান কোনঠাসা, সেখানে বিয়ের কথা ভাবা যায়?
ইদানিং বাবা-মায়ের কথা গুলো বেশ তীক্ষ্ণ লাগে শফিকের। সকালে দেরি করে উঠে কেন, বের হবার সময় এত ফিটফাট হয়ে যায় কেন, ইন্টার্ভিউ দিতে কেন এমন জুবুথুবু হয়ে যায়, সারাদিন বাসায় থাকে কেন, সারাদিন বাইরে টই টই করে কি করে, বাসায় সন্ধ্যা না ফিরে দুইটা টিউশন করলে কি হয়, এত রাতে বাসায় ফেরে কেন? শফিক ভেবে পায়না কি করলে তারা খুশি হবেন।
অয়নের সাথেও সমস্যা। কোনো কিছুতেই অয়ন তর্ক বাধায়। কিছু আনতে বললেও উঠে চলে যায়।
মুদি দোকানে বাকী পড়েছে ২২৭০ টাকা। বাকীতে চা সিগারেটও কপালে জুটে না।
শুক্রবার রাতে মন খারাপের আকাশে, ঝুপ করে অন্ধকার নামিয়ে রেখা জানায়, তার পক্ষে এভাবে আর অপেক্ষা করা সম্ভব না। কাউকেই কোনো কথা বলতে পারছে না। শফিক যদি পারে, তাহলে বাসায় এসে তাকে নিয়ে যাক বা দুজনে পালিয়ে যাক। রাতে খেতে বসে মাকে শফিক বলে সে বিয়ে করতে চায়। ভাত প্লেটে দিতে গিয়ে মা থমকে যায়। বলে, লজ্জা করে না, বাবা মায়ের ঘাড়ে বসে খাচ্ছিস, আর বিয়ের শখ। ঝেটিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দেবো হারামজাদা। শফিক খাবার রেখে উঠে দাঁড়ায়। তার জন্মদাত্রী একটিবারও তাকে ফেরানোর জন্য ডাকেনি। উল্টো রাতে বাবা বাসায় এসে আরো একদফা উচু গলায় তার বন্ধুদের ছেলেরা কি করছে আর নিজের ছেলে কি করছে বলে, হা হুতাশ ঝাড়লেন। শফিকের ভালো লাগেনি।
রাত এগারো টায় বাসা থেকে বেড়িয়ে যায় শফিক। মোড়ের দোকানী কালাম মিয়া ডাকে, বলে, ভাইজান, আর কয়দিন এমুন কইরা ঘুরবেন? আর আমার বাকী টাকাটাও দিয়ে দেন ভাইজান। চুপচাপ সামনে হেটে যায় শফিক। পকেটে আজ সকালে বন্ধু পিয়াসের থেকে ধার নেওয়া পাচশত টাকার একটা চকচকে নোট। এদিক সেদিক পায়চারি করে রাত বারো টায় বাসায় ফেরে। অন্যান্য দিনের মতোই বাবার কথা শুনে। আজই প্রথম হেসে উঠে শফিক, বলে, বাবা, আর এমনটা হবেনা। চোখের কোনে ঝিলিক মারে এক ফালি সুখ, প্যান্টের বা পকেটে হাত দিয়ে দেখে, কাছের শিশি টা ঠিকই আছে।
ঘরে যাওয়ার পরে অয়ন আসে। চড়া গলায় বলে, মা ডাকছে, আর বলছে তোর খাবার নিয়ে এভাবে বসে থাকতে পারবে না। হেসে উঠে শফিক। বলে, মাকে শুতে বল, কাল থেকে এমন আর হবে না।
রাত তিনটায় পকেটের ফেরত আসা পঞ্চাশ টাকা আর এক খালী শিশি মেঝেতে ফেলে লুটিয়ে পড়ে শফিক। তার খুব ইচ্ছে করে, রেখাকে একটা ফোন দেয়ার। সেদিন দুজনে গিয়েছিনু বনের দুটি লাইন শুনার। সেই ইচ্ছেরা শেষ রাতের পেচার মতোই তরল বিষের সাথে ফিকে হয়ে আসে।
আজ মংগলবার বিকেলে, শফিক মআরা যাওয়ার তিন দিন পরে, আজিমপুর কবরস্থানে দাড়িয়ে থাকা রেখা জানেইনা, কেন শফিকের এই জীবন প্রত্যাখ্যান।

রেখা এখন তাকিয়ে আছে সমুদ্রের চলে যাওয়ায়। কাদা মাখা প্যান্ট ভারি হওয়ায়, অনেকটা টেনে টেনে পা ফেলছে সমুদ্র। নেশাতুর চাহনীতে রেখাও হঠাৎ সমুদ্রের পিছনে পিছনে হাটা শুরু করলো।

(চলবে)

Leave a Reply