ঢাকা মেডিকেল আর ১৫ই আগস্টের অজানা আখ্যান।
১৯৭৫ সনের ১৪ ই আগস্টের রাত শেষ, জিগরি দোস্ত সহপাঠি সাদেকের ধাক্কায় ঘুম ভাঙ্গলো। বকশী বাজার ঢাকা মেডিকেল কলেজ হোস্টেলের ২৩৫ নম্বর রুমে আমার বিছানা থেকে বাইরে তাকালে বড় একটি গাছের ডালে প্রতিদিন অনেকগুলো শহুরে কাকের সরগরম আড্ডা আর কা কা শব্দ দিয়ে তুমুল বিতর্ক শোনা যেতো, প্রতিদিন আমি ওদেরকে তাকিয়ে দেখতাম ক্ষণিক, তারপর টেবিলের ওপরে রাখা কঙ্কালের করোটির দিকে তাকিয়ে, “গুড মর্নিং ডেডু ভাই” বলতাম। জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখি গাছটি শুন্য, কাকেরা কেউ নেই, টেবিলের ওপর ডেডু ভাইর মরা মাথাটাও নেই। ফার্স্ট ইয়ারে আমার পড়াশুনার জন্যে কঙ্কালটি উত্তরাধিকার সুত্রে আমার রুমমেট সিনিয়র আজাদ কাশ্মীরের নেওয়াজ ভায়ের কাছ থেকে পাওয়া।
মুক্তিযুদ্ধ শুরু হতে উনি তার নিজের দেশ পাকিস্তানে চলে গিয়েছিলেন, আমার জন্যে একটি চিরকুট লিখে, যার কথাগুলি এরকম ছিল, “কোন মরা মানুষটির হাড্ডি গুড্ডি এগুলি জানিনা, তোমহারা লিয়ে ছোড়কে গিয়া, ডেড ম্যান ডেডু ভাইকে লিয়ে কাকরাইল মসজিদ যাকে দোয়া করনা, মেরে লিয়ে ভি।” নেওয়াজ ভাই তবলিগে যেতেন। নামাজ পড়ে দোয়া করার সময় নিজের প্রয়োজন আল্লাহকে বলতে বলতে ডেডু ভাইর কথা মনে থাকতোনা।
স্পন্দন গোষ্ঠির মূল শিল্পী ডেন্টাল কলেজের নাসির আহমেদ অপুর গিটার প্রাকটিসে “পাগলার মন নাচাইয়া” ধরনের গানের সাথে টেবিলের ওপর ড্রাম সঙ্গত করতে গিয়ে ডেডু ভায়ের ফেমার, হিউমেরাস লম্বা হাড্ডি গুলি ভেঙ্গে গিয়েছিলো অনেক আগেই, শুধু তার করোটির খালি চোখের গর্তগুলি আমাকে নিয়ে মিটিমিটি হাসতো গভীর রাতে, চোখে চোখ পড়লে শুনতাম বলত, “তোর করোটিটা এত নড়ে কেন রে ?” তাই সকালে গুড মর্নিং বলতাম বিনয়ের সাথে। এখন মনে হয় সালাম আলাইকুম বলা উচিত ছিলো, কিনতু বরিশাল থেকে এসে ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি হয়ে ইংরেজী বললে নিজেকে একটু অন্যরকম উন্নত মনে হত।
সাদেকের কঠিন ধাক্কায় উঠে দাড়ালাম, কি হয়েছে তোকে ঝড়ো কাকের মতো লাগছে রে, টেবিল থেকে প্লাস্টিকের ব্রাশ ধরিয়ে বললাম, চুলগুলি ঠিক কর।
আমাকে পাত্তা না দিয়ে সাদেক বললো, চল ইমার্জেন্সিতে তাড়াতাড়ি, বঙ্গবন্ধু মারা গেছেন।
—কি, কে মারা গেছেন ?
—বঙ্গবন্ধু, এই মাত্র।
—কে বললো তোকে একথা?
—সোনা ইকবাল (সহপাঠি) বলেছে উনি ইমারজেন্সিতে আছেন । ও ঘুমাতে গেছে সারা রাত পড়েছে, পরীক্ষা আছে ওর।
—নিশ্চয়ই হার্ট এট্যাক। ওনার পাইপ খাওয়াটা আমার কোনোদিন ভালো লাগে নাই।
—নারে আমার মনে হয় পাকিস্তান জেলে ওনাকে স্লো পয়জন করা হয়েছে, এত কম বয়সে মরবেন কেন উনি ?
হেটে নয় অনেকটা দৌড়ের মতো ফজলে রাব্বীর গেট পেরিয়ে, ক্যাফে তাজের পরাটা ভাজার ডালডা পোড়ার লোভী গন্ধ ছেড়ে, পরিত্যক্ত রেল লাইন, রেইনট্রি গাছের সারি, ডান পাশে মেয়েদের হোস্টেলে সহপাঠিনিদের হৃদয় হরনকারিনী, মনমোহিনী সব চেহারা কিছুই মনে পড়ছেনা, শুধু ভাবছি বঙ্গবন্ধুর কি হতে পারে, উনি কি সত্যিই মারা গেছেন ? রাস্তাঘাট খালি, কেউ নেই কোনদিকে।আবছা অন্ধকার তখনো কাটেনি।
ঢাকা মেডিকেলের ইমারজেন্সিতে ডাক্তার ইকবাল ভাই তখন ডিউটিতে। বঙ্গবন্ধু কই, জানতে চাইলে উনি বললেন, আমাদের হাসপাতালে আসেননি, কোথায় জানিনা। পাশে হুইল চেয়ারে বসা সৌম্য চেহারার একজন বিষন্ন মা কে দেখলাম, পাশে উত্কণ্ঠিত চেহারার যুবক। ইমারজেন্সির ব্রাদার বললেন, ( শেখ কামালের স্ত্রী) আমাদের বকশী বাজারের সুলতানা আপার মা আর ভাই ওনারা। শেখ কামাল আর সুলতানাকে নাকি কারা উঠিয়ে নিয়ে গেছে গাড়ীতে করে, তাই ওনারা এসেছেন তাদের কোনো খোজ পাওয়া যায় কিনা।
এর মধ্যে হুড়মুর করে অনেক আহত নিহত লোক এসে গেল আমাদের সামনে। দেখি পুলিশের গাড়ি ভরে সবাইকে নিয়ে এসেছে রমনা থানার পুলিশ। আব্দুর রব সেরনিয়াবাত তখন মৃত, তার পরিবারের সদস্যরা, কেউ নিহত, কেউ আহত, বরিশালের পরিচিত রফিক মিল্টন কে দেখলাম, গুলি লেগেছে, বাচ্চা একটা ছেলে বছর পাচেক বয়স হবে, মৃত সেরনিয়াবাত সাহেবের পাশে লাশ হয়ে আছে, চেহারায় তখনো বিস্ময় আর বেদনা।
রমনা থানার ওসি আনোয়ার সাহেব এসেছেন সবাইকে নিয়ে, দৈনিক বাংলার মেডিকেল রিপোর্টার হিসাবে ওনার সাথে পরিচয় ছিলো, জিজ্ঞেস করলাম, কারা গুলি করেছে ?
—সর্বহারা পার্টি। আরিফ ভাই, শেখ মনি গুলি খেয়েছে ওনাকে একটু দেখেন, উনি বেচে আছেন এখনো।
ইকবাল ভায়ের নির্দেশে আমরা সব আহত রোগীদের নিয়ে দৌড় ৫ নম্বর ওয়ার্ডে। প্রফেসর এ টি সিদ্দিকী স্যারের ওয়ার্ড, স্যার কথা বলতেন কম, গম্ভীর মানুষ, ভয়ে তটস্থ থাকতাম আমরা, যেয়ে শুনি উনি ওটিতে, আহতদের নিয়ে আমরা আর নার্সরা রুটিন প্রটোকল শুরু করলাম। ওয়ার্ডে ঢুকে ডান পাশের শেষ দিকে আহত শেখ মনি ভাইকে পেলাম। হাতে ফ্লুইড লাইন। গলায় আর হাতে গুলি লেগেছিলো। ভাইটাল সাইন ভালো ছিলোনা, কিনতু জ্ঞান ছিল তখনো। শুকনা হ্যাংলা একজন মনি ভাইর মতই দেখতে তার কপালে শরীরে হাত বুলাচ্ছিলো আর বিলাপ করছিলো, শেখ হেলাল বা শেখ মারুফ দুজনের একজন হবেন যতদুর মনে পড়ে। আমরা ওনাকে সরিয়ে দিয়েছিলাম। মনি ভাই ফোকাস করার চেষ্টা করছিলেন আর কি যেন বলছিলেন, সাদেক আর আমি কান পাতলাম, —“আমি জানি আমাকে কে মেরেছে।”
দেখি ওনার পালস দ্রুত, ভলিউম লো, মনে হলো জ্ঞান হারাবেন এক্ষুনি, বললাম মনি ভাই আমরাও জানি কে মেরেছে, তাদের বিচার হবে, আপনি আল্লাহকে ডাকুন, পড়ুন তো আমার সাথে লা ইলাহা ইললাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ, অবাক হয়ে দেখলাম উনি ফোকাস করছেন, ওনার সর্ব শক্তি দিয়ে তার ঠোট নড়ছে, অস্ফুটে বেরিয়ে আসছে পবিত্র কলেমার প্রতিটি শব্দ। সাদেক তার ফ্লুইড চেক করছে, পালস ধরে আছে, উনি জ্ঞান হারালেন। আর ফিরে আসেননি উনি অধ্যাপক এটি সিদ্দিকী স্যার এর অনেক চেষ্টার পরেও।
এইসময় একজন ওয়ার্ড বয় আমাদের দৌড়ে এসে জানালো সে রেডিওতে শুনছে কোন একজন মেজর ডালিম বঙ্গবন্ধুকে মেরেছে। ৫ নম্বর ওয়ার্ডে কর্তব্যরত ডাক্তার নার্সরা স্থম্ভিত, বঙ্গবন্ধু নেই, এতক্ষণ সর্বহারা পার্টিকে ভিলেন মনে করেছিলাম আমরা। এর মধ্যে কে যেন জোরে বললো মিলিটারী আসছে আমাদের ওয়ার্ডে। মাত্র সেদিন পাকিস্তানী মিলিটারীর গুলি খাওয়া বাংলাদেশী মানুষগুলি উত্কন্ঠিত হয়ে তাকিয়ে মিলিটারীর নাম শুনে ।
একজন অফিসার ঢুকলেন, হাতে স্টেন। সাদেককে দেখে চিনে ফেললেন, আপনি মুক্তিযোদ্ধা সাদেক ভাই না ? সাদেক বললো আপনি জেনারেল ওসমানী সাহেবের এ ডি সি ভাই না ? উনি বললেন ইন চার্জ কে ?
সাদেক এটি সিদ্দিকী স্যারকে দেখিয়ে দিলে, স্যার পাংশু মুখে তাকিয়ে রইলেন, মনে হলো স্যার তার স্টেন গানের দিকে তাকাচ্ছেন ভয়ার্ত ভাবে। কিনতু অফিসারটি পা মিলিয়ে জোরে মিলিটারী স্যালুট করলো স্যার কে, “স্যার, আমাদের দুটো ছেলে গুলি খেয়েছে, ওরা আপনার ওয়ার্ডে আছে,একটু খেয়াল রাখবেন। ওরা বঙ্গবন্ধুর বাড়ির নিরাপত্তা প্লাটুনের।” গট গট করে বেরিয়ে গেলো অফিসারটি। ওই দিনই দুপুরে জানতে পেরেছিলাম সে ছিল মেজর নুর।
একটার পর একটা নাটকীয়তা এত অল্প সময়ে ঢাকা মেডিকেলের ৫ নম্বর ওয়ার্ডে ঘটেছিলো আমাদের চোখের সামনে ১৫ই আগস্ট ১৯৭৫ এর একটি অশুভ সকালে। সাদেক বললো, চল কলেজ থেকে ঘুরে আসি, পুরো কলেজ ফাঁকা, সেরনিয়াবাত সাহেব আর মনি ভাইর বাসায় যারা নিহত হয়েছেন তাদের বডি গুলি কলেজের সবুজ মাঠে জমা করে রাখা হয়েছে স্তুপের মতো । মর্গে জায়গা নেই, জায়গা তৈরী করা হচ্ছে।
বন্ধুদের খুজলাম, কেউ নেই, রাজনৈতিক ছাত্র নেতাদের কাউকে পেলামনা। কমন রুমের বেয়ারার শরিফ ভাই, আমাদের দুজনকে জড়িয়ে কাদলেন, বঙ্গবন্ধুকে মেরে ফেলেছে, আহারে বাচ্চাডারেও ছারে নাই, পাশ থেকে এক সিনিয়র ভাই বললেন, শরিফ ভাই কাদছেন কেন ? যাদের কাঁদার কথা তারা কোথায় ? ক্যন্টিনে রেডিও থেকে ভেসে আসছে যুদ্ধের গান, আর মাঝে মাঝে ” আমি মেজর ডালিম বলছি। ……..” .
আমার অবাক লাগছিলো, এত কিছু ঘটে গেলো আমরা একটাও গুলির শব্দ শুনিনি, রেডিওর ঘোষণা কানে আসেনি। ঢাকা মেডিকেলের এতগুলি মানুষ শুধু অন্য মানুষদের জীবন বাচানোর প্রয়াসে এত ব্যস্ত ছিলো যে আমরা অনেক পরে জানতে পেরেছি আসল ঘটনা। ডাক্তারদের কাছে মানুষের জীবন সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, ডিউটি আর ডিউটি, এজন্যে এই প্রফেশনটি সারা জীবন মানুষদের কাছে সন্মানিত থাকবে।
সাদেকের বাবা সার্জারির অধ্যাপক শামসুদ্দিন আহমেদ সিলেট মেডিকেল কলেজ ক্যাম্পাস ছাড়েননি মুক্তিযুদ্ধের সময়, ছেলেরা গুলি খেয়ে আসলে তাদের কে অপারেশন করবে? তাকে রুগী সহ হত্যা করেছিলো পাকিস্তানি মিলিটারী।
মিলিটারীদের কাজ দেশ বাচানো, ডাক্তারদের কাজ জীবন বাচানো, এই দুই দলের কেউ ভুল করে ফেললে বঙ্গবন্ধুর মত ফুলেরা ঝরে যায়, আর অধ্যাপক আহমেদের লাশের চোখ অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে, এ কেমন মিলিটারী ?
রুমে এসে শুয়ে পড়তেই টেবিলে দেখি ডেডু ভাইয়ের করোটি, কে যেন পড়তে নিয়ে ফেরত দিয়ে গেছে, চোখে চোখ পড়তেই শুনলাম বলছে,’ কি মন খারাপ ?”
জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখি কাকেরা সব ফিরে এসেছে, কোনো রা নেই, চুপচাপ বসে আছে, বঙ্গবন্ধু নেই, পাখিদেরও কিছু ভালো লাগছেনা।
লেখক: আরিফুর রহমান
I am sure this piece of writing has touched all the internet users, its really really good
piece of writing on building up new blog.
Very rapidly this web site will be famous among all blogging people, due
to it’s nice posts