মানুষের মন বড়োই অদ্ভুত, বিপরীতধর্মী চরিত্রের। মানুষ অদেখা অদৃশ্য আল্লাহকে বিশ্বাস করবেনা, কিন্তু অদেখা অজানা ভাগ্যে বিশ্বাস করবে। ভাবটা এই যে, আল্লাহ থাকলেও থাকতে পারেন, না থাকার সম্ভাবনাই বেশি, কিন্তু ভাগ্য অবিশ্যিই আছে। সবচেয়ে আজব ব্যাপার হচ্ছে কট্টর নাস্তিকও পৃথিবীতে ঐশ্বরিক কোন ফেনমেনোন স্বীকার করবেনা, কিন্তু নিজ জীবনে অনাকাঙ্খিত কিছু ঘটে গেলে বলবে, এটি আমার ভাগ্যে ছিল। তাই ভাগ্যে থাকতে পারে ভেবে মিলিয়ন ডলার লটারীর টিকেট ক্রয় করে ধর্মবিশ্বাসী, ধর্মহীন, নাস্তিক প্রায় সবাই। পুরস্কার পেলে সবাই বিজয়ীকে বলবে–ওনার লাকে ছিলো, যারা পাবেনা তারা নিজের ব্যাড লাককে দোষ দিয়ে গুডলাক থাকতে পারে আশা করে আবার টিকেট কিনবে। রাস্তার দুর্ঘটনায় পঙ্গু হলে দোষ ড্রাইভারের আর খারাপ কপালের, আল্লাহর নির্ধারিত ইচ্ছাতেই সব কিছু হয় তা কম লোকই চিন্তা করে। এইসব কারণে “কপালের লিখন না যায় খণ্ডন” অতি প্রচলিত প্রবাদে “আল্লাহর লিখন” কথাটি আসেনি। অন্য প্রবাদেও তাই বলে “কপালের ভোগ ভুগতেই হয়” –আল্লাহ অনুপস্থিত।
এইভাবে কপাল, ভাগ্য বা লাক আলাদা একটি শক্তি আলাদা একটি জগৎ ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বাসের পাশাপাশি সমান্তরাল ও বিতর্কহীন ভাবে একটি আস্থা ও বিশ্বাস হিসাবে মানবমনে বিরাজ করছে অনাদিকাল থেকে। ভাগ্য নিয়ে ঈশ্বর অবিশ্বাসী মেটাফিজিক্স বিজ্ঞানী ও দার্শনিকগন বিভিন্ন তাত্বিক ব্যাখ্যা দিয়ে শেষতক বলেছেন ভাগ্য কোন স্রষ্টা কর্তৃক পূর্ব নির্ধারিত কিছু নয়, এটি কর্মফল। কিন্তু একজনের জ্যাকপট লটারি জেতা আর ধনী পরিবারের সন্তান হয়ে ধনী হওয়া আর রাজার পুত্র রাজা হবার কোন ব্যাখ্যা খুঁজে না পেয়ে আবার ভাগ্যকে তারা মেনে নিয়েছেন ইনিয়ে বিনিয়ে। এই ভাবে বিভিন্ন পর্যবেক্ষণ থেকে বোঝা যায়, “ভাগ্য জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করে” এই কথাটি অবচেতন মনে সংশয়হীন ভাবে বিশ্বাস করে অনেক মানুষ, সেই ভাবনায় সৃষ্টিকর্তার কোন স্থান নেই।
এনাদের অবচেতন মন ভাগ্যকে একটি অমোঘ স্বেচ্ছাচারী শক্তি মনে করে। কিন্তু কেউ জানেনা, ভাগ্য কোথায় থাকে, লাক দেখতে কি রকম, সেটি কি জীবিত নাকি মৃত নাকি কোন বুদ্ধিমান শক্তি? ভাগ্য কি আলাদা আলাদা সবার কপালে বাস করে? ভাগ্যের কি নিজস্ব কোন সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা আছে যে একজনের জন্যে সে ভালো হবে আরেকজনের জন্যে খারাপ? মানুষ বুদ্ধিমান হলেও ভাগ্যের ওপর ভীষণভাবে নির্ভর করে বিভিন্ন রকম ঝুঁকি নেয়, ভাগ্য পরীক্ষা করে, ভাগ্য গণনা করে। ভাগ্যের ওপর এত বিশ্বাস মানুষের তাই ভাগ্যোন্নয়নের জন্যে অথবা দুর্ভাগ্য থেকে রক্ষা পাবার জন্য মানুষ কতরকম ট্রিটমেন্ট, কতরকম প্রতিষেধক নেয়!
বৈজ্ঞানিক কোন ব্যাখ্যা না থাকা স্বত্বেও ভারতবর্ষের অনেক মানুষ যার যার জন্মদিনের জন্মক্ষনে কোন গ্রহ উপগ্রহের অবস্থান কোথায় ছিলো তার অংক কষে কোষ্ঠী বানায়। তারা বিশ্বাস করে পৃথিবীর আশপাশের গ্রহ উপগ্রহের মানব জীবন নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা আছে এবং জীবনের ভাগ্যের ফের আর দুর্ভাগ্য গ্রহ উপগ্রহের প্রভাবের ওপর নির্ভরশীল। এই বিশ্বাস যেকোন ধর্মবিশ্বাস থেকে আলাদা। যারা এগুলিতে বিশ্বাস করেন তারা ধর্মের সাথে এটিকে মেলান না, তারা এটিকে একটি জ্ঞানের বিভাগ একটি আলাদা শাস্র মনে করেন এবং এভাবেই ভাগ্যের আলাদা অস্তিত্ব, আলাদা অবস্থান তৈরি হয়েছে এনাদের ভাবনায় আরেকজন ঈশ্বরের মতো।
এনারা মনে করেন শনি
দুর্ভাগ্য দেয় তাই শনির দশা কথাটি চালু হয়েছে। বৃহস্পতি তুঙ্গে থাকলে
সম্পদ বৃদ্ধি হয় বলে ভাগ্য উপাসকরা গভীর ভাবে বিশ্বাস করে। এইসব মানুষ
ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য আঙুলে বিভিন্ন রকম পাথরের অঙ্গুরীয় পরিধান করে।
সম্পদ বৃদ্ধির জন্য গোমেদ বা গ্রানেট, এগেট বা আকিক, স্যাফায়ার বা নীলা,
রুবি, এমারেল্ড, ডায়মন্ড যার যার জন্মদিন হিসাব করে বাংলাদেশের গরিব
ধনীদের ভাগ্য পরিবর্তনের পাথর বাতলে দেয় একদল জ্যোতিষী। বাংলাদেশের প্রতিটি
দৈনিক, সাপ্তাহিক পত্রিকায় রাশিফল, আজকের দিনটি কেমন যাবে কলাম থাকবেই।
বাচ্চাদের কপালের পাশে কালো টিপ দিয়ে ভাগ্য কেড়ে নেয়া নজর বন্ধ করে আপামর
বাঙালী মায়েরা। সিংহলের লোকেরা ধন বাড়ানোর জন্য পরিধান করে পাডপাড়াজা —
সাত রংয়ের নীলা পাথর। ইরানীরা বিভিন্ন সংখ্যা ভিত্তিক কোরআনের আয়াত বিভিন্ন
পাথরের ওপর লিখে পরিধান করে নজর বন্ধ করতে আর সৌভাগ্য আনতে। মিশরিয়রা একটা
চোখের লকেট ঝুলিয়ে রাখে। পশ্চিমা শ্বেতাংগরা শয়তানের পূজা করে ভাগ্য
বদলাতে। ভারতের অনেক মুসলমান ৭৮৬ নাম্বার লাগায় ফোনে, গাড়িতে, তাবিজে।
হিন্দুরা হাতের কব্জিতে মন্ত্রপুত: রঙ্গীন সুতো, কপালে সিঁদুরের ছাপ, ও
ভাগ্য বদলানোর তান্ত্রিক তাবিজ ব্যবহার করে দেবদেবীর মূর্তির পাশাপাশি।
চাইনিজরা আংটি লাগায় ব্যাঙ আর ড্রাগনের চেহারা দিয়ে, তারা ঘর সাজায়
ফেংশুই শাস্র মতে। ফেংশুই মতে বাড়িতে বা অফিসে কারোর ঢোকা বা বেরনোর ছবি
আয়নায় প্রতিবিম্বিত না হওয়াই ভালো। এরকম শতশত আইডিয়া আছে ফেংশুই সংস্কারে।
আফ্রিকানরা ভুডু ও উডু প্রাকটিস করে। অনেক মুসলমান গলায় ঝুলান আয়াতুল কুরসী অথবা ছোট কুরআনের মাদুলী। অনেক আল্লাহ বিশ্বাসী যুক্তি দেন এগুলি হচ্ছে আল্লাহর দেয়া ওষুধ তাই পরিধান করি। অথচ কোরআন আর সূরা গলায় ঝুলানোর জন্যে নয় বা হাতে বাধার জন্যে নয়, সূরা-কালাম বারবার বুঝে পাঠ করার জন্য। পৃথিবীর সব ধর্ম বিশ্বাসীরা আর ধর্মহীন ও নাস্তিকেরা এই ভাবে সৃষ্টিকর্তার প্রতি বিশ্বাসকে পাশ কাটিয়ে লাক, কপাল, বা ভাগ্য পরিবর্তনের চেষ্টা করে নিজস্ব সংস্কারের মাধ্যমে।
আল্লাহ ভাগ্য বা তকদীর নির্ধারিত করে রেখেছেন এই কথাটি সহজে বিশ্বাস করেনা মানুষ, কিন্তু ভাগ্যে ছিল বলে এটি হয়েছে, কপালে ছিলোনা বলে ওটি হয়নি, এই কথা বলে ভাগ্যকে সব ক্রেডিট বা ডিসক্রেডিট দিবে তবুও মন থেকে আল্লাহই এটি নির্ধারিত করে রেখেছেন তা কেউ সহজে বলবেনা। কারণ এটি বললে সে ঈমানদারদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে। অনেক মানুষ ঈমানদার হওয়াকে পশ্চাদপদতা ও মূর্খতা মনে করেন। এভাবেই মানুষ বিভ্রান্ত হয়।
সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ তাঁর সৃষ্ট সবকিছুর কি হবে
না হবে তা তার সুপার ডুপার কম্পিউটার লওহে মাহফুযে আগেই প্রোগ্রাম করেছেন।
আল্লাহ বলেন,ওয়া কুল্লুশাইয়িন ফা‘আলূহু ফিঝ ঝুবুর। তারা যা কিছু করেছে,
সবই ঝুবুরে বা তক্তিতে/ ফলকে/ লিপিবদ্ধ আছে। সুরা ক্বামার ৫৪:৫২।
আরবীতে ঝুবুর এর অর্থ দেখলে প্রশ্ন আসে আল্লাহর কম্পিউটারেরও কি ফ্লাট কোন
স্ক্রীন আছে? আল্লাহই ভালো জানেন। যাই থাকুক আর যেভাবেই থাকুক আল্লাহ
আমাদের ভাগ্য বা তকদীর আগেভাগেই নির্ধারিত করে লিখে রেখেছেন তাঁর কুদরতি
সিস্টেমের মেমোরি ফলকে। ভাগ্য আল্লাহর সমান্তরাল কিছু নয় এটি আল্লাহর একটি
প্রোগ্রাম মাত্র। রোবট যেমন তার ডিজাইনারের প্রোগ্রামকে ভিত্তি করে স্বাধীন
ভাবে কোন কাজ করার সিদ্ধান্ত নিতে পারে অনেকটা সেই রকম।
কাক আর তোতা পাখি দুটোকেই খুব কুৎসিত হিসাবে বানানো হয়েছিলো। তোতা প্রতিবাদ করলে তাকে সুন্দর বানানো হয়। কাক স্রষ্টার ইচ্ছার ওপর সন্তুষ্ট হয়ে রইল। আজ অধিকাংশ তোতা খাঁচায় থাকে আর কাকের দল মুক্তপাখী হয়ে উড়ে বেড়ায়। ভাগ্যে সন্তুষ্ট থাকা বোঝার জন্য এই গল্প।
প্রতিটি ঘটনার পেছনে একটি অসীম জ্ঞানী সিদ্ধান্ত কাজ করে আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের, যা আমরা কখনোই বুঝবনা। সুতরাং আল্লাহকে কখনো জিজ্ঞেস করবোনা, কেন?
এজন্যেই নিকোলা টেসলা বলেছেন, “মস্তিষ্ক কেবলমাত্র একটি গ্রহীতা, মহাবিশ্বে এমন একটি মূল রয়েছে যা থেকে আমরা শক্তি, জ্ঞান এবং অনুপ্রেরণা অর্জন করি।” যারা এই জ্ঞান অর্জন করতে অপারগ হয় তারাই আল্লাহকে চিনতে পারেনা।
আল্লাহ বলেন, “পৃথিবীতে এবং ব্যক্তিগতভাবে তোমাদের উপর কোন বিপদ আসে না; কিন্তু তা জগত সৃষ্টির পূর্বেই কিতাবে লিপিবদ্ধ আছে। নিশ্চয় এটা আল্লাহর পক্ষে সহজ। এটা এজন্যে বলা হয়, যাতে তোমরা যা হারাও তজ্জন্যে দুঃখিত না হও এবং তিনি তোমাদেরকে যা দিয়েছেন, তজ্জন্যে উল্লসিত না হও। আল্লাহ কোন উদ্ধত অহংকারীকে পছন্দ করেন না, সুরা হাদীদ ৫৭: ২২ ও ২৩
লেখকঃ Arifur Rahman